বুদ্ধ ধর্ম বিশ্বের শান্তির ধর্ম

(জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক সর্ব প্রকার রোগ ব্যাধি উপদ্রভ থেকে মুত্তি হয়ে নির্বাণ যাবার চিত্ত উৎপত্তি হোক)

ধর্মচক্র




বুদ্ধমতে ভবচক্রের (wheel of existence) দ্বাদশ নিদান:
=====================================
(১) অবিদ্যা (ignorance) : অবিদ্যা হলো সকল দুঃখের মূল কারণ। অবিদ্যা মানে অজ্ঞান। এখানে অবিদ্যা অভাব-বাচক নয়, বরং বিরোধ-বাচক অর্থে প্রতিপাদন হয়েছে। অর্থাৎ অবিদ্যা মানে জ্ঞানশূন্য নয়, জ্ঞানের বিপক্ষ। যেমন যে বস্তু অবাস্তবিক তাকে বাস্তবিক ভাবা, সে বস্তু দুঃখময় তাকে সুখময় ভাবা, যে বস্তু আত্মা নয় (অনাত্মা, non-self) তাকে আত্মা ভাবা হচ্ছে অবিদ্যার প্রতীক। অবিদ্যা হলো সত্যের সম্যক জ্ঞানের অভাব। অবিদ্যার প্রভাবে আমরা অনিত্য সংসারকে নিত্য বলে মনে করি। বস্তুর যথার্থ স্বরূপকে না জানার কারণ অবিদ্যা প্রতিফলিত হয়ে সংস্কারকে উৎপন্ন করে। অর্থাৎ এই অবিদ্যাজনিত কামনা ও বাসনা থেকে উদ্ভূত হয় আমাদের সংস্কার।
.
(২) সংস্কার (impression) : সংস্কার হলো আমাদের অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ। অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মাবস্থাই সংস্কার। পূর্বজন্মের কর্ম ও অনুভবের দরুন উৎপন্ন সূক্ষ্ম ও বাসনাময় বস্তু হলো সংস্কার। সংস্কারের কারণ হচ্ছে অবিদ্যা। অবিদ্যাজনিত কর্ম একপ্রকার শক্তি উৎপন্ন করে। এই শক্তি আবার কর্মের ফল সৃষ্টি করে। এক জীবনের সংস্কার পরের জীবনের চিন্তা ও কর্মকে উৎপন্ন করে। ফলে পূর্বজন্মের সংস্কার থেকেই পরজন্মের বিজ্ঞান বা চেতনা উদ্ভূত হয়।
.
(৩) চেতনা বা বিজ্ঞান (consciousness) : আমাদের বিজ্ঞান বা চেতনার কারণ হলো অতীত জীবনের সংস্কার। চেতনা থাকে বলেই এই জীবদেহ মাতৃগর্ভে দিন দিন বাড়তে থাকে, এই বিজ্ঞানের দরুনই শিশুর শরীর ও মন বিকশিত হয়। অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার চৈতন্যরূপে মাতৃজঠরে আবির্ভূত হয় এবং জীবদেহ গঠন করে। কাজেই চেতনা থেকে উদ্ভূত হয় জীবদেহ বা নামরূপ।
বৌদ্ধদর্শন মতে এই বিজ্ঞান হচ্ছে প্রতিসন্ধি (জন্ম) স্কন্ধ। প্রতিসন্ধি ক্ষণে বা উপপত্তি ক্ষণে গর্ভস্থ পাঁচটি স্কন্ধ (রূপ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার) হচ্ছে বিজ্ঞান বা চেতনা। উল্লেখ্য, ভূতব্যতিরিক্ত অমূর্ত তত্ত্বকে বৌদ্ধগণ স্কন্ধ বলেন।
.
(৪) নামরূপ (mind body organism) : দৃশ্যমান শরীর ও মনের সংবলিত সংস্থানবিশেষ হচ্ছে নামরূপ। সোজা কথায় দেহ-মনের সংগঠন। নামরূপের কারণ হলো চেতনা বা বিজ্ঞান। এই নামরূপ থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের ষড়ায়তন বা ছয়টি ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়গুলোর নিবাস শরীরে ও মনে। পাঁচ বাহ্যেন্দ্রিয় শরীরে থাকে বলে মনে করা হয় এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মন হচ্ছে আন্তর। নামরূপের অস্তিত্ব না থাকলে এই ছয়টি ইন্দ্রিয় উদ্ভূত হতো না।
.
(৫) ষড়ায়তন (six sense organs) : ষড়ায়তন হলো বিশেষ বিশেষ বিষয়যুক্ত পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনের সঙ্কলন। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক হচ্ছে বাহ্য পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন হচ্ছে আন্তর ইন্দ্রিয়। এই ছয়টি ইন্দ্রিয়ই বিষয়ের সাথে সম্পর্ক গ্রহণ করে। ইন্দ্রিয়ের প্রাদুর্ভাবকাল হতে ইন্দ্রিয়, বিষয় ও চেতনা বা বিজ্ঞানের সন্নিপাতকাল পর্যন্ত হচ্ছে ‘ষড়ায়তন’। এই ছয়টি ইন্দ্রিয় আছে বলেই স্পর্শ সম্ভব হয়। কাজেই ষড়ায়তন থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের স্পর্শ।
.
(৬) স্পর্শ (sense contact) : স্পর্শ হলো আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাথে তাদের বিষয়ের সংযোগ। যদি বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক না হতো তবে ইন্দ্রিয়ানুভূতি (বেদনা) উদ্ভূত হতো না। সুখ-দুঃখাদির কারণ জ্ঞানের শক্তি উৎপন্ন হবার পূর্ব অবস্থা হচ্ছে স্পর্শ। এই স্পর্শ থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের অনুভূতি বা বেদনা।
.
(৭) বেদনা বা অনুভূতি (sense experience) : আমাদের বেদনা বা অনুভূতির কারণ হলো স্পর্শ। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন অনুভবই বেদনা। বুদ্ধমতে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জীবের সুখাত্মক অনুভূতি হয় (যা জীবের তৃষ্ণাকে মৈথুনের পূর্বে যে-যাবৎ মৈথুনরাগের সমুদাচার না হয় সে-যাবৎ অবস্থা), তাকে ‘বেদনা’ সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই বেদনা থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের তৃষ্ণা বা ভোগ-বাসনা।
.
(৮) তৃষ্ণা বা ভোগবাসনা (craving) : শব্দ, স্পর্শ, রূপ ইত্যাদি বিষয়ের বা ভোগ্যবস্তুকে ভোগ করার বাসনাই হলো তৃষ্ণা। অর্থাৎ তৃষ্ণা হচ্ছে বিষয়লাভের তীব্র ইচ্ছা। তৃষ্ণার কারণে জীব সাংসারিক বিষয়ের পশ্চাতে অন্ধের মতো দৌঁড়ায়। ভোগ ও মৈথুনের কামনাকারী জীবের অবস্থাই হচ্ছে তৃষ্ণা। রূপাদি কামগুণ ও মৈথুনের প্রতি রাগের সমুদাচার তৃষ্ণার অবস্থা। এর অন্ত হয় যখন এই রাগের প্রভাব থেকে জীব ভোগের পর্যেষ্টি আরম্ভ করে। এই তৃষ্ণা থেকেই উদ্ভূত হয় উপাদান বা বিষয়ের প্রতি অনুরাগ।
.
(৯) উপাদান বা বিষয়ানুরাগ (mental clinging) : উপাদান হলো জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা আসক্তি। যে জীব ভোগের পর্যেষ্টিতে দৌঁড়-ঝাঁপ করে তার সেই অবস্থা হচ্ছে উপাদান। এই উপাদানের কারণ হলো তৃষ্ণা এবং এই উপাদান থেকে উদ্ভূত হয় ভব বা পুনর্বার জন্মগ্রহণের প্রস্তুতি।
(১০) ভব (tendency to be born) : ভব কথার অর্থ হলো পুনর্বার জন্মগ্রহণের প্রবৃত্তি বা ব্যাকুলতা। মানুষ বা জীবের মধ্যে জন্মগ্রহণের প্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকায় তাকে জন্ম গ্রহণ করতে হয়। এই প্রবৃত্তি জীবকে জন্ম নিতে প্রেরিত করে। উপাদানবশে জীব কর্ম করে, যার ফল হচ্ছে অনাগত ভব। ‘ভব’ হচ্ছে কর্ম যার দরুন জন্ম হয়। এ হচ্ছে কর্মভাব। যে অবস্থায় জীব কর্ম করে তা হচ্ছে ভব। যেহেতু ভব থেকে উদ্ভূত হয় জাতি বা জন্ম, কাজেই পুনর্জন্মের কারণ হলো ভব।
.
(১১) জাতি (rebirth) : জাতি শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্ম। এ হচ্ছে পুনঃ প্রতিসন্ধি (জন্ম), অর্থাৎ পুনর্জন্ম। মরণান্তর প্রতিসন্ধি কালে পঞ্চস্কন্ধ হচ্ছে জাতি। প্রত্যুৎপন্নভবের আলোচনায় যে অঙ্গকে ‘বিজ্ঞান বা চেতনা’ নাম দেয়া হয় তাকে অনাগত ভবের সমীক্ষায় ‘জাতি’ বলা হয়। (সংশ্লিষ্ট দার্শনিক পরিভাষায় বিষয়টা অনুধাবনে যে জটিল আকার ধারণ করে বাস্তবে তা এতো জটিল নয়; প্রথম আর্যসত্য দ্রষ্টব্য)। সোজা কথায়, জীব যদি জন্মগ্রহণ না করতো বা শরীর ধারণ না করতো তাহলে তাকে জরামরণের অধীন হতে হতো না। কাজেই জীবের জরামরণের কারণ হলো জাতি বা জন্ম।
.
(১২) জরামরণ (old age and death) : জরামরণ মানে জরা ও মরণ। আক্ষরিক অর্থে বার্ধক্য ও মৃত্যু। বৌদ্ধদর্শনে ‘জরামরণ’ বলতে রোগ, শোক, নিরাশা ইত্যাদি সাংসারিক সমস্ত দুঃখকেই বুঝানো হয়েছে। জীবের জরামরণ উদ্ভূত হয় তার জাতি বা জন্মের কারণে। তাই জরামরণাদি হলো সকল দুঃখের কারণ।
.
এই বারোটি নিদানের মধ্যে প্রথম দুটি পূর্ববর্তী জীবনে, পরের আটটি বর্তমান জীবনে এবং শেষ দুটি ভবিষ্যৎ জীবনে কার্যকরী হয়। এখানে মূল কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যার কারণে জীব বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না বলে তৃষ্ণা থেকে মুক্ত হতে পারে না এবং বার বার জন্মচক্রে পতিত হয়ে দুঃখ থেকেও মুক্ত হতে পারে না। এই অবিদ্যা থেকেই অন্য নিদানগুলি আবির্ভূত হয়ে ‘ভবচক্র’ অর্থাৎ অস্তিত্বের বৃত্তকে বারবার আবর্তিত করছে। তাই এই চক্রটির আবর্তনকে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে-
.
[ অতীত জীবন বা পূর্বজন্ম ]
> ১.অবিদ্যা > ২.সংস্কার >
[ বর্তমান জীবন বা এ জন্ম ]
> ৩.চেতনা বা বিজ্ঞান > ৪.নামরূপ > ৫.ষড়ায়তন > ৬.স্পর্শ > ৭.বেদনা > ৮.তৃষ্ণা > ৯.উপাদান >
[ ভবিষ্যৎ জীবন বা পরজন্ম ]
> ১০.ভব > ১১.জাতি > ১২.জরামরণ > (১.অবিদ্যা)
.
উপরিউক্ত কারণ শৃঙ্খল থেকে বোঝা যায় যে, কার্যের দিক থেকে যেমন দুঃখ সর্বশেষ উৎপন্ন কার্য, তেমনি কারণের দিক থেকে অবিদ্যা সর্বপ্রথম কারণ

No comments

Powered by Blogger.